চুল মানুষের সৌন্দর্যের এক অপরিহার্য অংশ। আজকের এই আধুনিক যুগে চুল রং করা ফ্যাশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে নতুন লুকের জন্য বিভিন্ন ধরনের রং ব্যবহার করা এখন খুবই সাধারণ বিষয়। তবে এই নিয়মিত চুল রং করার প্রক্রিয়ায় প্রায়ই আমরা ভুল করি যে, এতে চুল ও মাথার ত্বকের উপর কেমন প্রভাব পড়ে। অনেকেই জানেন না, বারবার চুল রং করলে চুলের স্বাস্থ্যের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
চুলের রং করার রাসায়নিক প্রক্রিয়া যদিও চুলকে নতুন রঙে সজ্জিত করে, কিন্তু এর সঙ্গে থাকে একাধিক ঝুঁকি ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। নিয়মিত এবং অতিরিক্ত রাসায়নিকযুক্ত হেয়ার ডাই ব্যবহার করলে চুলের ক্ষতি, ভেঙে যাওয়া, পাতলা হওয়া, মাথার ত্বকে জ্বালাপোড়া, চুলকানি ও অ্যালার্জির মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এই ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, সঠিক যত্ন এবং কখনো কখনো প্রাকৃতিক উপায় গ্রহণ।
নিয়মিত রং করার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
১. চুলের ক্ষতি ও ভেঙে যাওয়া
চুলের রং করার জন্য ব্যবহৃত ডাই বা কালারিং প্রডাক্টে থাকে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, যেমন অ্যামোনিয়া, প্যারাফেনিলেনডায়ামাইন (PPD), হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ইত্যাদি। এই রাসায়নিকগুলো চুলের প্রাকৃতিক প্রোটিন ও সুরক্ষিত স্তর ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে চুলের গোড়া দুর্বল হয়ে পড়ে এবং চুল ভেঙে যেতে শুরু করে।
অনেক সময় চুলের রং করার আগে ব্লিচ করা হয়, যা চুলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমিয়ে দেয়। ব্লিচের ফলে চুলের গোড়া ফেটে যেতে পারে, চুল ক্রমশ শুষ্ক ও ঝরঝরে হয়ে যায়। নিয়মিত ব্লিচ ও রং করলে চুলের মূল গঠন নষ্ট হয় এবং চুল পড়ার হার বাড়ে।
২. মাথার ত্বকে জ্বালাপোড়া ও অ্যালার্জি
চুল রং করার সময় ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদান মাথার ত্বকে জ্বালাপোড়া, লালচে ভাব, চুলকানি এবং অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। যাদের ত্বক অতিসংবেদনশীল, তারা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকেন। হেয়ার ডাই প্রয়োগের পর মাথায় জ্বালাপোড়া বা চুলকানি শুরু হলে তা অবহেলা করা উচিত নয়, কারণ তা একটি সম্ভাব্য অ্যালার্জি বা সংক্রমণের সংকেত।
৩. চুল পাতলা হয়ে যাওয়া
রাসায়নিক হেয়ার ডাই চুলের গোড়া থেকে প্রয়োজনীয় তেল ও পুষ্টি শুষে নেয়। ফলশ্রুতিতে চুলের মুটি দুর্বল হয়ে যায় এবং চুল পাতলা হতে শুরু করে। পাতলা চুল সহজেই ভেঙে যায় ও ঝরে পড়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই পাতলা হওয়া চুলের স্বাভাবিক বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে।
৪. চুলের প্রাকৃতিক রঙ ও টেক্সচার পরিবর্তন
নিয়মিত রং করার ফলে চুলের প্রাকৃতিক রঙ হারিয়ে যায়। রাসায়নিক প্রক্রিয়ার কারণে চুলের মসৃণতা, কোমলতা ও ঝলমলে ভাব কমে যায়। পরিবর্তে চুল শুষ্ক, ঝাপসা ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
কেন চুলের ক্ষতি হয়?
চুলের ক্ষতির মূল কারণ হলো হেয়ার ডাইয়ের রাসায়নিক উপাদান। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান রাসায়নিক হলো:
- অ্যামোনিয়া: এটি হেয়ার কালারিং প্রক্রিয়ায় রংয়ের পিগমেন্ট চুলের ভেতরে প্রবেশ করাতে সাহায্য করে। কিন্তু এটি চুলের প্রাকৃতিক তেল ও প্রোটিন ধ্বংস করে চুল শুষ্ক ও দুর্বল করে তোলে।
- হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড: এটি চুলের প্রাকৃতিক রঙ খোয়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু চুলের প্রোটিন ক্ষতি করে এবং চুলকে সহজে ভাঙ্গা ও ঝরার জন্য প্ররোচিত করে।
- পারফেনিলেনডায়ামাইন (PPD): এটি চুলের রংকে স্থায়ী করে। তবে অনেকেই এই রাসায়নিকের প্রতি অ্যালার্জিক হয়ে থাকেন, যা ত্বকে জ্বালাপোড়া ও ফোস্কার সৃষ্টি করে।
এছাড়াও চুলের বারবার রং পরিবর্তন করলে চুলের কিউটিকল (কেশরক্ষক স্তর) ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে চুল শুষ্ক ও দুর্বল হয়ে পড়ে।
কিভাবে নিয়মিত চুল রং করার ক্ষতি এড়াবেন?
১. কম রাসায়নিকযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার করুন
চুলের যত্নে অর্গানিক এবং প্রাকৃতিক উপাদানযুক্ত হেয়ার ডাই বেছে নেওয়া উত্তম। রাসায়নিক কম থাকলে চুলের ক্ষতির ঝুঁকি কমে যায়। আজকাল বাজারে অনেক ফার্মাসিউটিক্যাল ও বায়ো-ব্র্যান্ডের প্রোডাক্ট পাওয়া যায়, যেগুলো তুলনামূলক কম রাসায়নিকযুক্ত।
২. চুল রং করার মাঝে যথাযথ বিরতি দিন
চুলকে পুনরায় নিজেকে ঠিক করার সময় দিন। অন্তত ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ বিরতি দিয়ে চুল রং করুন। এতে চুলের গোড়া কিছুটা শক্তিশালী হয় এবং ক্ষতি কম হয়।
৩. ব্লিচ করার পর অতিরিক্ত যত্ন নিন
যদি ব্লিচ করতে হয়, তাহলে অবশ্যই পরে চুলের জন্য ময়েশ্চারাইজার ও প্রোটিন বেসড ট্রীটমেন্ট ব্যবহার করুন। এতে চুলের ক্ষতি কিছুটা কমানো যায়।
৪. নিয়মিত তেল ও হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করুন
চুলের প্রাকৃতিক তেল মেরামত ও পুষ্টি যোগাতে সাহায্য করে। নারকেল তেল, আমন্ড তেল, বা আর্গান তেল নিয়মিত মাথায় লাগান। সপ্তাহে অন্তত একবার প্রোটিন বেসড হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করলে চুলের স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
৫. হেয়ার ডাই ব্যবহারের আগে স্কাল্প পরীক্ষা করুন
নতুন কোনো হেয়ার ডাই ব্যবহারের আগে ত্বকের একাংশে পরীক্ষা করুন যাতে অ্যালার্জি বা জ্বালাপোড়া না হয়।
৬. হেয়ার পার্লারে নয়, বাড়িতেই সাবধানতার সঙ্গে রং করুন
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, ভালো মানের হেয়ার পার্লারে গিয়ে রং করানো উচিত। আর যদি বাড়িতে নিজে করেন, তবে রং করার সময় সতর্ক থাকুন, বেশি রাসায়নিক একবারে ব্যবহার করবেন না।
প্রাকৃতিক উপায় ও বিকল্প
চুলের রং পরিবর্তনের জন্য প্রাকৃতিক উপায়গুলো বেশি স্বাস্থ্যকর। এগুলোতে রাসায়নিক নেই বা খুবই কম পরিমাণে থাকে।
- হেনা: প্রাকৃতিক উপায়ে চুল রং করার অন্যতম নিরাপদ উপায়। হেনা চুলকে শক্তিশালী ও চকচকে করে।
- কফি বা চা: গাঢ় রঙের জন্য কফি বা কালো চা দিয়ে চুল ধোয়া যেতে পারে।
- বেবী হেয়ার রংয়ের জন্য বিটরুটের রস: এটি চুলে হালকা রঙ দেয় এবং স্বাস্থ্যকর।
- মাথার ত্বক ও চুলের জন্য নারকেল তেল ও আর্গান তেলের নিয়মিত ব্যবহারে চুল সুন্দর ও শক্তিশালী থাকে।
উপসংহার
নিয়মিত চুল রং করার ফলে চুলের ক্ষতি হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়, কারণ অধিকাংশ রংয়ে থাকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। তবে সচেতনতা ও সঠিক যত্নের মাধ্যমে এই ক্ষতি অনেকটাই এড়ানো সম্ভব। স্বাস্থ্যকর ও কম রাসায়নিকযুক্ত প্রোডাক্ট ব্যবহার, মাঝে মাঝে বিরতি, এবং প্রাকৃতিক উপায় বেছে নেওয়া উচিত। চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য নিয়মিত তেল-মাস্ক ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।
সবশেষে, নিজের চুলের স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিন, কারণ সুস্থ চুলই আপনার সৌন্দর্যের সবচেয়ে বড় গুণ।