আজকের আধুনিক যুগে চুলের যত্নে বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও উপকরণ ব্যবহৃত হচ্ছে। সেই সঙ্গে প্রচলিত রয়েছে নানা ধরনের চিরুনি, যার মধ্যে প্লাস্টিক ও কাঠের চিরুনি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। প্লাস্টিকের চিরুনি সুলভ ও সহজলভ্য হওয়ায় এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও, সম্প্রতি পরিবেশবান্ধব ও প্রাকৃতিক পণ্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেড়েছে। এ কারণে কাঠের চিরুনি আবার নতুন করে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, প্লাস্টিকের চিরুনির তুলনায় কাঠের চিরুনি কি চুলের জন্য আসলেই ভালো?
কাঠের চিরুনি: প্রাচীন ঐতিহ্য ও আধুনিক ব্যবহার
মিশর, চীন, জাপানসহ অনেক প্রাচীন সভ্যতায় কাঠের চিরুনি ব্যবহারের ইতিহাস পাওয়া যায়। সেগুলো মূলত প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব হওয়ার কারণে বিশেষভাবে পছন্দ করা হতো। আজকের দিনে অনেক অনলাইন উদ্যোক্তা কাঠের চিরুনি নিয়ে কাজ করছেন এবং এটি পরিবেশ সচেতন গ্রাহকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
নিশাত মেহেদী, যিনি ‘দীঘল’ ব্র্যান্ডের স্বত্বাধিকারী, উল্লেখ করেন, “প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ার কারণে কাঠের চিরুনি নতুন করে জনপ্রিয় হচ্ছে।” এই প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, শুধু চুলের যত্ন নয়, বরং পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্মত পণ্য ব্যবহার করাও এখন অনেকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
চুল ও মাথার ত্বকের জন্য কাঠের চিরুনি কেন ভালো?
ঢাকার হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চর্মরোগ বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আফজালুল করিম বলেন, “চুলের ধরন অনুযায়ী চিরুনি নির্বাচন করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, সঠিক চিরুনি ব্যবহার না করলে চুল ও মাথার ত্বকে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে।”
১. কম তীক্ষ্ণ দাঁত, কম ক্ষতি
কাঠের চিরুনির দাঁতের তীক্ষ্ণতা প্লাস্টিকের চিরুনির তুলনায় অনেক কম। ফলে কাঠের চিরুনি ব্যবহারে মাথার ত্বকে ক্ষত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। বিশেষ করে সংবেদনশীল ত্বক যেমন শিশু, বয়স্ক বা যারা মাথার ত্বকে জ্বালা-ইচ্ছে অনুভব করেন তাদের জন্য কাঠের চিরুনি অনেক বেশি উপকারী।
২. স্থির বিদ্যুৎ উৎপাদন কম
প্লাস্টিকের চিরুনি ব্যবহারের সময় চুলে স্থির বিদ্যুৎ তৈরি হয়, যা চুলকে রুক্ষ ও বিউঁটেড়া করে তোলে। কাঠের চিরুনি ব্যবহার করলে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না, তাই চুল দেখতে এবং অনুভবেও মসৃণ ও সুস্থ থাকে।
৩. সহজে জট ছাড়ানো এবং ভাঙা কমানো
কাঠের চিরুনি ঘর্ষণ কম হওয়ায় সহজেই চুলের জট ছাড়ানো যায়। এতে চুল ভাঙা এবং ডগা ফাটা কম হয়। বিশেষ করে যারা দীর্ঘ ও ঘন চুলের মালিক, তাদের জন্য প্রশস্ত দাঁতের কাঠের চিরুনি সবচেয়ে উপযোগী।
৪. রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি ও ত্বকের স্বাস্থ্য
কাঠের চিরুনির ভোঁতা ও মসৃণ দাঁত মাথার ত্বকে হালকাভাবে ম্যাসাজের মতো কাজ করে। এটি মাথার ত্বকে রক্ত সঞ্চালন বাড়িয়ে চুলের গোড়ায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে সাহায্য করে। ফলে চুল দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মাথার ত্বকে খুশকি কমে।
৫. প্রাকৃতিক তেলের সুষম বণ্টন
আমাদের মাথার ত্বক থেকে প্রাকৃতিক তেল (সিরাম) নিঃসৃত হয় যা চুলকে স্বাস্থ্যবান ও উজ্জ্বল রাখে। কাঠের চিরুনি এই তেলকে চুলের গোড়া থেকে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত সমানভাবে ছড়িয়ে দেয়, ফলে চুল অতিরিক্ত তৈলাক্ত বা শুষ্ক হয় না।
প্লাস্টিকের চিরুনি: সুবিধা ও অসুবিধা
প্লাস্টিকের চিরুনি সস্তা ও হালকা হওয়ায় তা বহন ও ব্যবহার সহজ। বিভিন্ন ডিজাইন ও রঙে পাওয়া যায় যা অনেকের কাছে আকর্ষণীয়। তবে এর কিছু অসুবিধাও রয়েছে যা দীর্ঘমেয়াদে চুলের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
- স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি: প্লাস্টিক চিরুনি ব্যবহার করলে চুলে স্থির বিদ্যুৎ জমে, যা চুলকে রুক্ষ ও ভঙ্গুর করে তোলে।
- চুল ভাঙার আশঙ্কা: প্লাস্টিকের চিরুনি দাঁত তীক্ষ্ণ হওয়ায় এটি সহজেই চুলের আঁচড়ে ক্ষতি করতে পারে।
- পরিবেশ দূষণ: প্লাস্টিক একটি অজৈব পদার্থ, যা বর্জ্যে পরিণত হলে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
- ত্বকের সমস্যা: সংবেদনশীল ত্বকের ক্ষেত্রে প্লাস্টিকের চিরুনি ব্যবহার মাথায় জ্বালা বা চুলকানি সৃষ্টি করতে পারে।
কাঠের চিরুনির বিভিন্ন ধরণ ও তাদের উপকারিতা
প্রাকৃতিক কাঠের অনেক ধরণের চিরুনি বাজারে পাওয়া যায়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিম কাঠের ও চন্দন কাঠের চিরুনি। এই চিরুনি গুলো শুধু পরিবেশ বান্ধবই নয়, বরং চুল ও মাথার ত্বকের জন্য বিশেষ উপকারী।
নিম কাঠের চিরুনি
নিমের গুণাগুণ চুলের জন্য অনেক ক্ষেত্রে অপরিসীম। নিম কাঠের চিরুনি ব্যবহারে মাথার ত্বকের জ্বালা-পোড়া ও খুশকি কমে যায়। নিম ত্বক ও চুলের নানা সমস্যা প্রতিরোধে সাহায্য করে।
চন্দন কাঠের চিরুনি
চন্দন কাঠ ত্বককে ঠান্ডা রাখে এবং চুলের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এর সুবাসও ত্বককে প্রশান্তি দেয় এবং মাথার ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা কমায়।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব দিক থেকে কাঠের চিরুনি
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে চিন্তা বেড়েছে। প্লাস্টিক ভেঙে যেতে অনেক সময় নেয় এবং পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী দূষণ সৃষ্টি করে। কাঠের চিরুনি biodegradable অর্থাৎ সহজে পচে গিয়ে পরিবেশে ক্ষতি করে না। তাই এটি পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
স্বাস্থ্যের দিক থেকেও কাঠের চিরুনি প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হওয়ায় এটি ব্যবহার করলে ত্বকের সংবেদনশীলতা কমে এবং এলার্জির আশঙ্কা কম থাকে। এর ফলে শিশু ও বয়স্কদের জন্য কাঠের চিরুনি বিশেষভাবে উপযোগী।
কাঠের চিরুনি ব্যবহারের টিপস
- চুল ধরনে উপযুক্ত কাঠের চিরুনি নির্বাচন করুন (পাতলা চুলে সংকীর্ণ দাঁত, ঘন চুলে প্রশস্ত দাঁত)।
- চুল আঁচড়ানোর সময় হালকা হাতে ব্যবহার করুন, বেশি জোরে না।
- ব্যবহারের পর চিরুনি ভালোভাবে পরিষ্কার ও শুকিয়ে রাখুন যাতে ব্যাকটেরিয়া না জন্মায়।
- নিয়মিত চিরুনি পরিবর্তন করুন কারণ পুরাতন চিরুনি তীক্ষ্ণ ও নষ্ট হতে পারে।
উপসংহার
সাধারণত কাঠের চিরুনি প্লাস্টিকের চিরুনির তুলনায় চুলের জন্য অনেক বেশি উপকারী। এটি চুল ও মাথার ত্বককে কম ক্ষতিগ্রস্ত করে, চুল ভাঙা ও ডগা ফাটা কমায়, রক্ত সঞ্চালন বাড়ায় এবং চুলের প্রাকৃতিক তেল সুষমভাবে ছড়িয়ে দেয়। এছাড়াও, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই হওয়ায় কাঠের চিরুনি ব্যবহার এখন যুগোপযোগী ও প্রয়োজনীয়।
তাই আপনি যদি আপনার চুল ও পরিবেশের যত্ন নিতে চান, তবে প্লাস্টিকের চিরুনি থেকে দূরে থেকে কাঠের চিরুনি বেছে নিতে পারেন। বিশেষ করে যাদের মাথার ত্বক সংবেদনশীল, তাদের জন্য কাঠের চিরুনি নিঃসন্দেহে একটি ভালো পছন্দ।
আপনার চুলের জন্য আজই পরিবর্তন করুন — প্লাস্টিক নয়, কাঠের চিরুনি ব্যবহার করুন এবং সুস্থ, মসৃণ চুলের আনন্দ উপভোগ করুন।